মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা ইউনিয়ন ঘুমধুম। ৬৪.৭৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির এই ইউনিয়নে ১৬ হাজার ৪৭৯ লোকের বাস। ঘুমধুমের ৮০ শতাংশ মানুষের প্রধান পেশা কৃষিকাজ। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে গোলাবারুদের আওয়াজে ভীতি ছড়িয়েছে বেশ। নিরাপত্তাহীনতায় জমিতে পা মাড়াচ্ছেন না কৃষক। যাঁরা সাহস নিয়ে ক্ষেতে নামছেন- কখন গোলা পড়ে সে ভয়ে তাঁদেরও চাষবাসে নেই মন। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কমেছে শিক্ষার্থী উপস্থিতি। সীমান্তের শূন্যরেখার রাবার বাগানের অন্তত দুই হাজার শ্রমিক আতঙ্কে এক রকম নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। দিনমজুর শ্রমিকের অবস্থা আরও ভয়াবহ। অনেকেই কাজ না পেয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে থাকছেন। সবকিছু মিলিয়ে এক অস্থির পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন সেখানকার ভয়ার্ত নারী-পুরুষ।
চাষিরা জানান, সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পাহাড়ে সমানে চলছে গোলাগুলি। মাঝেমধ্যে গোলাবারুদ এপারেও ছুটে আসায় ঘুমধুমের জনবসতিতে ছড়িয়েছে আতঙ্ক। জমিতে রোপা ও আমন ধান চাষ করা হলেও ফসল পরিচর্যার জন্য ভয়ে মাঠে যেতে পারছেন না চাষিরা। তাই সামনে চাহিদামতো ফসল উৎপাদন নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। একই দশা পাহাড়ে জুমচাষিদেরও।
তুমব্রু এলাকার চাষি রমজান আলী বলেন, ‘এই মৌসুমে এক একর জমিতে ধান চাষ করেছি। রোপণ করার পর থেকে নিরাপত্তার অভাবে ধানের পরিচর্যা করতে মাঠে যেতে পারছি না। এ ছাড়া বিজিবির পক্ষ থেকেও সীমান্ত এলাকায় ঘোরাফেরা না করতে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।’
আরেক চাষি আলী হোসেন বলেন, ‘এ মৌসুমে প্রায় দুই একর জমিতে ধান চাষের উদ্যোগ নিয়েছি। সময়মতো পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় পুরো জমিতে এখনও ধান রোপণ শেষ করতে পারিনি। বাকি জমিতে ধান রোপণ করতে মাঠেও যেতে পারছি না, সবকিছু মিলিয়ে মহাসংকটে পড়েছি।’
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঘুমধুম ইউনিয়নে আবাদি জমি আছে ১ হাজার ৫৫ একর। এর মধ্যে এক ফসলি জমি ৬২৮ হেক্টর, দুই ফসলি ৪৭৪ হেক্টর আর ৩ ফসলি জমি ৫৭ হেক্টর।
ফলো করুন-
ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন সমকাল ইউটিউব
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইনামুল হক বলেন, ‘সীমান্তে গোলাগুলির কারণে মানুষের মধ্যে একটু ভীতি ছড়িয়েছে। এ আতঙ্ক কৃষকদের মাঝে কী পরিমাণ প্রভাব পড়েছে, তা এখনও বলা যাচ্ছে না।’
গতকাল রোববার সকালে ঘুমধুমের তুমব্রু এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সীমান্তের প্রায় ২০ কিলোমিটারের মধ্যে তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫৫২ শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে গতকাল উপস্থিত ছিল ৪৩০ জন।
মোহাম্মদ হোসেন নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার ছেলে তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সীমান্তে গোলাগুলির কারণে নিরাপত্তার কথা ভেবে ১৫ দিন ধরে তাকে স্কুলে যেতে দিচ্ছি না। ‘
রোববার সকালেও সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি হয়েছে উল্লেখ করে তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘কয়েক সপ্তাহ ধরে সীমান্তে গোলাগুলির কারণে শুধু তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়, ঘুমধুম ইউনিয়নের প্রায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার ৩০ শতাংশ কমে গেছে। সীমান্তের এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামীতে শিক্ষার্থী উপস্থিতি আরও কমে যাবে।’
এদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখার ৩৯, ৪০ ও ৪১ নম্বর পিলারের কাছে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে স্থানীয় লোকজনের ২০টির বেশি রাবার বাগান আছে। এতে শ্রমিক আছেন ৩ হাজারের বেশি। ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া মর্টার শেল রাবার বাগানের পাশে এসে পড়ায় সেখানকার দুই হাজার শ্রমিককে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। চার দিন আগে শ্রমিকরা কাজে ফিরে গেলেও এখন তাঁরা গোলাবারুদ আতঙ্কে নির্ঘুম দিন কাটাচ্ছেন।
সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা একাধিক সূত্র এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যে কখন গোলাগুলি শুরু হয়, কখন থামে- সেটার কোনো পূর্বাভাস নেই। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মর্টার শেল কিংবা গুলি এসে পড়লে শঙ্কা দেখা দেয়। এর আগেও দু’বার হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া দুটি মর্টার শেল এসে পড়ার ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল বাংলাদেশ।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘শূন্যরেখার আশপাশে প্রায় ৮০০ একর জমিতে বাংলাদেশি কৃষকরা জুম, ধান ও শাকসবজি আবাদ করেন। সীমান্তে ব্যাপক গোলাগুলি ও বাংলাদেশ অংশে গোলাবারুদ এসে পড়ায় চাষিরা আতঙ্কে ক্ষেত-খামারে নামতে সাহস পাচ্ছেন না।’
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস বলেন, ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থানীয় এলাকাবাসীদের আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
আবারও ঢুকছে রোহিঙ্গা: মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘর্ষের কারণে সীমান্ত দিয়ে আবারও বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। গত দুই দিনে অন্তত ৩০ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। তবে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দাবি করেছেন, এখনও কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে পারেনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে ঢোকার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে আরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, তুমব্রু, উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ঢোকার অপেক্ষায় আছেন তাঁরা।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল গফুর বলেন, কয়েক দিন ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যে সংঘর্ষ চলছে, সেটার অজুহাতে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসছেন। সুত্র: সমকাল
পাঠকের মতামত